রিভেলিনোর
মনের একতারা দুঃখ জাগানিয়া টুংটাং সুরে বেজে যাচ্ছিল নিরন্তর। ছোট্ট পাখি ক্যানারিনহোর হলুদ পালকধোয়া বিখ্যাত ১০ নম্বর জার্সির
মর্যাদাটা থাকছে না বলে। পেলের উত্তরসূরি
হিসেবে ব্রাজিলের ওই জার্সির অধিকার ছিল ধ্রুপদী এই প্লে-মেকারের। পরবর্তী সময়ে জিকো, রিভালদো, রোনালদিনহোর মতো নক্ষত্ররা শৈল্পিক সৃজনশীলতা আর চোখ
ধাঁধানো দক্ষতায় বিশ্বমঞ্চ আলোকিত করেছেন ১০ নম্বরে। কিন্তু হালফিলে অমন কেউ আর কোথায়! খুঁজে পেতে কাউকে না পেয়ে
রিভেলিনোর দীর্ঘশ্বাসের কথা শোনা গিয়েছিল ২০১৪ বিশ্বকাপ আসর শুরুর আগে আগে।
সংবাদমাধ্যম
এখন গিয়ে আবার রিভেলিনোর মুখোমুখি হলে পারে। তাহলে
নিশ্চিতভাবেই তাঁর মনের একতারার উচ্ছ্বাসের ঝংকার বাঙ্খয় হবে মুখের বুলিতে। হবে না কেন? ব্রাজিল বিশ্বকাপ যেভাবে পারফরম্যান্সের
ঝরনাধারায় ভিজিয়ে দিচ্ছেন নেইমার, তাতে
ওই কিংবদন্তির আনন্দিত না হয়ে উপায় আছে! ব্রাজিল ফুটবল ফিরিয়েছেন ‘জোগো বোনিতো’র সৌন্দর্যে, ১০ নম্বর জার্সিকে ফিরিয়েছেন সৃষ্টিশীল
ঐতিহ্যের শেকড়ে- ২২ বছরের এই তরুণ তাই শুধু রিভেলিনো কেন, সব ব্রাজিলিয়ানেরই স্বপ্ন-সাগর সেঁচে
তোলা মুক্তো যেন!
আজ
চিলির বাধা ডিঙিয়ে ‘সেলেসাও’দের কোয়ার্টার
ফাইনালে নিয়ে যাওয়ার অভিযানেও সবার দৃষ্টি সেই নেইমারে। নজর তাঁর জাদুকরী পায়ের কারিকুরিতে। ৬৪ বছর ধরে বয়ে চলা মারাকানাজো-ক্ষত দূর করার মহৌষধ যে ওই তরুণের
পায়ে লুকিয়ে, এ নিয়ে দ্বিমত
নেই কোনো। আজ পূর্বসূরিদের প্রায়শ্চিত্ত
করার পথে আরেকটি বড় পদক্ষেপ ফেলবেন নেইমার- এ প্রত্যাশা সব ব্রাজিলিয়ানের।
ব্রাজিলিয়ানদের
প্রত্যাশা বরাবরই চূড়াস্পর্শী। অল্পে
তুষ্ট হতে জানে না তারা। আর এবারের
বিশ্বকাপের আয়োজক যখন নিজেরাই, তখন
সেই প্রত্যাশার আকাশ ছিল অনেক অনেক বড়। তারায়
ঠাসা সেই আকাশের বৃহস্পতি হয়ে ছিলেন নেইমার। তবে
সমান্তরালে শঙ্কার এক চোরা ভাবনাও ভেসে উঠছিল ভুস করে। বয়সে অপরিণত, বিশ্বমঞ্চে
অপরীক্ষিত একজন যে তাদের স্বপ্নপূরণের পাঞ্জেরি! সেই নেইমারের না ধ্রুবতারার মতো
জ্বলার পরিবর্তে উল্কাপাতের পতনের পরিণতি হয়!
গ্রুপ
পর্বের তিন ম্যাচে সেই ভাবনা ভুল প্রমাণিত হতে দেখে ব্রাজিলিয়ান সে কী উল্লাস!
কী
করেছেন নেইমার? প্রথম ম্যাচে
ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে শুরুতে পিছিয়ে পড়া হতচকিত দলকে সমতায় ফিরিয়েছেন দারুণ প্লেসিং
শটে করা গোলে। এরপর পেনাল্টি থেকে দ্বিতীয়
লক্ষ্যভেদে জয়সূচক গোল। এই দুই গোলই
শুধু নয়, গতি-ড্রিবলিং, টার্ন, সতীর্থদের সঙ্গে বোঝাপড়ায় ‘ক্যানারিনহো’ আক্রমণের প্রাণভোমরা ছিলেন নেইমার। মেক্সিকোর বিপক্ষেও সৃজনশীলনতায় তিনি
অনন্য। কিন্তু প্রতিপক্ষের গোলরক্ষক
সেদিন যে হয়ে গিয়েছিলেন ভিনগ্রহের! একের পর এক অতিমানবীয় সব সেভে কেবল নেইমার না, হতাশায় ডোবান পুরো ব্রাজিলকে। স্বপ্নযাত্রায় তাতে ধাক্কা লাগে ঠিক, কিন্তু ওতে মুষড়ে যাননি ব্রাজিলের
নাম্বার টেন। বরং বর্শার ফলার মতো পরের খেলায়
ক্যামেরুনকে আক্ষরিক অর্থে ছিন্নভিন্ন করে ফেলেন তিনি। আবার জোড়া গোল, আবার
ম্যাচসেরা, আবার ব্রাজিলের
স্বপ্ন-ক্যারাভানকে কক্ষপথে ফেরানো। মেক্সিকোর
বিপক্ষে ওই ধাক্কাটা তখন কী মনে হচ্ছিল? অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার আগে ধনুকে বসানো তীরের ওই
একটু পেছনে টেনে ধরা মাত্র!
পেছন
থেকে সেই ধনুককে অব্যর্থ নিশানায় পৌঁছার দীক্ষা দিচ্ছেন লুই ফেলিপে স্কলারি। ‘বিগ
ফিল’-এর সঙ্গে ‘লিটল নেই’ মিলেই
যে ব্রাজিলের রাজযোটক! কোচ হিসেবে পুনরায় দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে নেইমারকে কেন্দ্র
করে দল সাজিয়েছেন। তাঁর গায়ে ১০ নম্বর জার্সি তুলেও
দিয়েছেন তিনি। ‘নাম্বার টেন’-এর
পজিশনে যেমন এই তরুণকে নিয়ে আসেন, তেমনি
প্রয়োজন-প্রতিপক্ষ বুঝে আক্রমণের বাঁ প্রান্তেও নেন সরিয়ে। দুজনের সম্পর্কটাও পিতা-পুত্রের। সর্বক্ষণ ছায়া দিয়ে নেইমারকে আগলে রেখেছেন স্কলারি। ব্রাজিলের বিশ্বকাপ জিততে হলে যে এই
তরুণের ঝলসে ওঠার বিকল্প নেই, সেটি
তিনি জানেন। কিন্তু যখন নেইমার সত্যি সত্যি
জ্বলে উঠলেন, জ্বালিয়ে খাক
করে দিতে শুরু করলেন প্রতিপক্ষকে- তখন কিন্তু আবার প্রত্যাশার স্রোতে বাধ দিতে
দেরি করেননি ২০০২ বিশ্বকাপ জেতানো কোচ। চিলির
বিপক্ষে ম্যাচের আগে তাই স্কলারির কণ্ঠে এমন উচ্চারণ, ‘নেইমার
একা আমাদের জেতাতে পারবে না, একা
হারাতে পারবে না। জিতবে ও সবার সঙ্গে, হারবেও তাই।’
বলছেন
বটে স্কলারি। কিন্তু সেটি বিশ্বাস করার মতো লোক
সবুজ এই গ্রহে খুব বেশি পাওয়া যাবে না। কারণ
ব্রাজিলকে বিশ্বকাপ জেতাতে পারেন নেইমার একাই। ব্রাজিল দলটির শক্ত এক কাঠামোর খোলস আছে বটে, পোড় খাওয়া অভিজ্ঞ সব ফুটবলারের সঙ্গে
সৃজনশীলতার আনন্দে মেতে ওঠা এক দল তরুণও- কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটি নেইমারেরই দল। প্রথম ও তৃতীয় ম্যাচে তিনি পেরেছেন বলে
ব্রাজিল জিতেছে। দ্বিতীয় ম্যাচে পারেননি বলে দলও
জয় পেতে ব্যর্থ।
চিলির
বিপক্ষে তাই ব্রাজিলিয়ানদের বাজি আবার সেই নেইমারে। ৬৪ বছর বয়ে চলা মারাকানাজো-ভূত তাড়ানোর ‘ওঝা’ও তিনি। ১৯৫০-এর বেদনার বিষাদসিন্ধু পেরিয়ে ২০১৪-তে
ব্রাজিলিয়ানদের আনন্দের মহাসাগরে ভাসিয়ে নিতে তিনি।
নেইমার। একমাত্র নেইমারই।
No comments:
Post a Comment