Friday, April 4, 2014

গ্রীষ্মের তাপদাহে সারাদেশে ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়েছে



গ্রীষ্মের তাপদাহে রাজধানীসহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ আইসিডিডিআরবি পরিচালিত ঢাকা হাসপাতালে গত কয়েক দিনে রোগীর চাপ অনেকটা বেড়েছে। প্রতি ঘণ্টায় রোগী ভর্তি হচ্ছে ২৩ জনেরও বেশি। আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ শিশু। মেডিসিন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অত্যধিক গরম ডায়রিয়া রোগী বৃদ্ধির জন্য দায়ী। ক্ষেত্রবিশেষে বিশুদ্ধ পানির সংকট পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে।

আবহাওয়া অফিসের তথ্য বলছে, ৮-১০ দিন ধরে রাজধানীতে তাপমাত্রা ৩৫ থেকে ৩৮ ডিপ্রি পর্যন্ত উঠানামা করেছে। এক পশলা বৃষ্টিতে শুক্রবার অবশ্য তাপমাত্রা কিছুটা কমে আসে। ফলে রোগীর চাপও সাময়িকভাবে কমেছে বলে জানিয়েছে আইসিডিডিআরবি। সংস্থাটির রোগী নিবন্ধন শাখা জানাচ্ছে, গত সপ্তাহজুড়ে হাসপাতাল প্রাঙ্গণে ছিল ডায়রিয়া রোগীর সারি। সোমবার এই হাসপাতালে ২৪ ঘণ্টায় ৫৫৮ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। এটা সপ্তাহে সর্বোচ্চ। মঙ্গলবার এই সংখ্যা ছিল ৫৩৫ জন। বুধবার ভর্তি হয়েছে ৫০১ জন রোগী। বৃহস্পতিবার সংখ্যাটি কিছুটা কমে ৪৯৩ জনে দাঁড়ায়। আর শুক্রবার বিকাল ৫টা পর্যন্ত ভর্তি করা হয়েছে ৩০৬ জনকে। কর্তব্যরত চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, বৃষ্টির ফলে রোগীর চাপ একটু কমেছে। গরম বাড়লে আবারও পরিস্থিতি অবনতির আশংকা আছে।

আইসিডিডিআরবি শর্টস্টে ইউনিটের প্রধান ডা. আজহারুল ইসলাম খান বলেন, বছরে দু’বার ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা যায়। একবার গ্রীষ্মে, আরেকবার শীতে। চৈত্রের শেষভাগে হঠাৎ গরম বেড়ে যাওয়ায় ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা যাচ্ছে। রাজধানীর বিপুলসংখ্যক মানুষ অনিরাপদ পানি পান করেন। অসচেতনতা ও দারিদ্র্যের কারণে কেউ বাসি খাবার খান। গরমে একটু পরিত্রাণের আশায় অনেকে রাস্তার ধার থেকে কিনে শরবত খেয়ে নিচ্ছেন। বিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসক বলছেন, এগুলোই ডায়রিয়া আক্রান্তের ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ। গ্রীষ্মের তাপদাহ যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, রাজধানীর খিলগাঁও, বাড্ডা, যাত্রাবাড়ী, মুগদাপাড়া, বাসাবো, মিরপুর, তেজগাঁও ও টঙ্গী এলাকা থেকে বেশিসংখ্যক রোগী আসছে। দ্রুত হাসপাতালে আনা হলে রোগীদের বৃহদাংশ ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বাড়ি ফিরতে পারে। এই হাসপাতালে ডায়রিয়া রোগীদের সম্পূর্ণ বিনামূল্যে চিকিৎসা দেয়া হয়। রোগীর সঙ্গে একজন স্বজনও বিনা খরচে থাকার সুযোগ পান।

বৃহস্পতিবার দুপুরে হাসপাতাল চত্বরে গিয়ে দেখা গেল রোগীর ভিড়। মারাত্মক ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে নেতিয়ে পড়া অনেক শিশুকে কোলে নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন অভিভাবকরা। পূর্ব গোড়ান থেকে আনা আড়াই বছরের এক শিশুর অভিভাবক বলেছেন, তার টিনশেড ঘরে অত্যধিক গরম। ঠিকমতো পরিচ্ছন্ন খাবার দিতে পারেননি। বুধবার দুপুর থেকে বাচ্চাটা প্রায় ১০ বার পাতলা পায়খানা করেছে। প্রতিবেশীদের পরামর্শে হাসপাতালে নিয়ে এসেছি।
কর্তব্যরত চিকিৎসকরা জানান, সাধারণ ডায়রিয়া রোগী হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে স্যালাইন দিলে সেরে যাচ্ছে। মারাত্মক ডায়রিয়া রোগীদের বিস্তৃত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সেবা দিতে হয়। এতে কয়েক দিন ভর্তি থাকা লাগে।

আইসিডিডিআরবি কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রতি বছর এ সময়ে বেশি রোগীর চাপ সামাল দিতে তারা অভ্যস্ত। হাসপাতালের নির্ধারিত বেডে রোগী সংকুলান না হলে আলাদা তাঁবু খাঁটিয়ে সেবার ব্যবস্থা আছে। একসঙ্গে দুই হাজার রোগী সামাল দিতেও প্রতিষ্ঠানটি সক্ষম।

সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, রাজধানীতে নিরাপদ পানির সরবরাহে ঘাটতি আছে। ফ্ল্যাট বাসা-বাড়িতে সমস্যা কম হলেও আধাপাকা, টিনশেড ও বস্তি ঘরের বাসিন্দাদের জন্য পানির নিরাপত্তা বিধান করা যায়নি। প্রতি বছর এ সময়ে পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান এবং ওয়াসার কর্মকর্তারা পাল্টাপাল্টি অভিযোগ লিপ্ত হন। অসচেতনতার কারণে ও গ্যাস সরবরাহ না থাকায় গাঁটের পয়সা খরচ করে অনেকে পানি ফুটিয়ে পান করতে পারে না। গরম বেশি পড়লে খাবার সামগ্রীও দ্রুত পচা-বাসি হয়। রেস্টুরেন্টগুলো ঝুঁকিপূর্ণ অনেক খাবার মানুষকে খাইয়ে দিচ্ছে। এসব কারণেই ডায়রিয়ায় ভুগছে মানুষ।

জনস্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের (আইপিএইচ) আইভি ফ্লুইড উৎপাদন শাখা বলেছে, গ্রীষ্মে চাহিদা বাড়ে স্যালাইনের, উৎপাদনও অনেকটা বাড়ানো হয়। বিভিন্ন হাসপাতালে ডায়রিয়া রোগী চিকিৎসায় অতিরিক্ত স্যালাইনের প্রয়োজন পড়ে। এই চাহিদা সামাল দিতে ইতিমধ্যে উৎপাদন জোরালো করা হয়েছে। আইসিডিডিআরবি জানিয়েছে, ডায়রিয়া ঝুঁকিপূর্ণ সময় এলে খাবার স্যালাইন তৈরির কাজ জোরদার করা হয়।

মিরপুরে প্রতি বছর ডায়রিয়া মৌসুমে সংকট তৈরি হয়। এজন্য ২০০৯ সাল থেকে সরকারি সহায়তা নিয়ে আরেকটি কেন্দ্র চালাচ্ছে আইসিডিডিআরবি। পার্শ্ববর্তী স্থানের সাধারণ রোগীরা এই কেন্দ্র থেকে সেবা নেন। জটিল রোগীদের ঢাকা হাসপাতালে রেফার করা হয়।

এ সময়ে করণীয় : ডায়রিয়াজনিত প্রতিকূল পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কে পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. টিটো মিঞা। যুগান্তরকে তিনি বলেন, ডায়রিয়া থেকে বাঁচতে হলে পানি ফুটিয়ে খেতে হবে। খাবার গ্রহণের আগে অবশ্যই সাবান দিয়ে হাত ধোয়া চাই। খাবার খাওয়ার কাজে ব্যবহৃত থালা-বাসন পরিষ্কার রাখা উচিত। হাত-মুখ যে পানিতে ধুবেন, সেটাও বিশুদ্ধ হওয়া দরকার। বিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসক বলছেন, হোটেল-রেস্তোরাঁয় অনেক সময় ফিল্টার পানি বলে পাইপের পানি চালিয়ে দেন অসৎ ব্যবসায়ীরা। রাস্তার ধারে যেসব শরবত, আখের রস ও খোলা পানীয় বিক্রি হয়- সেগুলো নিরাপদ নয়। এসব পানীয় পরিহার করতে হবে।

সরকারি উদ্যোগ নেই : ডায়রিয়া মৌসুমে সরকারের নির্বিকার থাকার সমালোচনা করেছেন আইসিডিডিআরবি চিকিৎসক ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ঝুঁকিপূর্ণ এই সময়ে মানুষকে তথ্য দিয়ে সচেতন করা উচিত। সরকার সবার জন্য নিরাপদ পানি দিতে পারছে না। মাইকিং, লিফলেট, ব্যানার করে মানুষকে তথ্য দিতে পারে। রোগ থেকে বাঁচতে হলে করণীয় বিষয়ে টিভি ও রেডিওতে প্রচারণা চালানো যায়। মানুষকে স্যালাইন তৈরির পদ্ধতি সম্পর্কে তথ্য দেয়া যায়। অথচ সেদিকে মনোযোগ দেয়া হচ্ছে না। 

No comments:

Post a Comment