Tuesday, April 1, 2014

ভাঙছে ১৯ দলীয় জোট



১৯ দলীয়’ জোটের অন্যতম শরিকদল অমুক...। গাল ভরা নামই শুধু, এদের রাজনৈতিক পরিচিতি কিছুটা থাকলেও নেই সাংগঠনিক শক্তি, অনেকের নেই নিবন্ধন। তাই জোটের সমাবেশ আর দুএকটি সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিতি ছাড়া বাস্তবে তাদের কার্যক্রম দখা দুষ্কর। কাগজে কলমে আর ফাঁকা বুলিতে সীমিত হয়ে পড়েছে ‘১৮ দলীয়’ জোটের নামসর্বস্ব শরিকদের কার্যক্রম। আর তাই বিএনপির মতো শক্তিশালী দলের মুখাপেক্ষী হয়ে রয়েছে শরিকরা। এর সুযোগও নিচ্ছে বিএনপি।
 
যথাযথ মূল্যায়ন না পাওয়ার অভিযোগে জোট থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে শরিক দল। ইতোমধ্যেই গত সোমবার ১৯ দল থেকে বের হয়ে গেছে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ ভাসানী)। ফলে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট আবারো ১৮ দলে পরিণত হয়েছে। আরো একাধিক দল জোট থেকে বের হয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলেও জানা গেছে।

সোমবার বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে জোট ছাড়ার ঘোষণা দিয়ে ন্যাপ ভাসানীর চেয়ারম্যান শেখ আনোয়ারুল হক বলেন, ‘১৯ দলীয় জোট থেকে আমরা যথাযথ মূল্যায়ন পাচ্ছিলাম না। এ কারণেই জোট ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। জোটে থেকে কর্মীদের জন্য কিছুই করতে পারিনি। আমাদের কর্মীরাও চেয়েছে আমরা যেন জোট থেকে বেরিয়ে আসি।’

তিনি বাংলামেইলকে বলেন, ‘আমরা এখন বামফ্রন্টের মতো রাজনীতি করতে চাই। আর না হলে বসে থাকবো।’

শরিকদলের নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, শরিকদলগুলোর মধ্যে জামায়াত ও বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (জেপি) ছাড়া কোনো দলকে দলই মনে করে না বিএনপি। শরিকদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে ১৯ দলের বলে চালিয়ে দিচ্ছে দলটি। অন্যদিকে নিজেদের খুঁটির জোর না থাকায় শরিকরাও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব তুলে দিচ্ছে বিএনপির কাঁধে। ফলে জোটের মধ্যে সমন্বয়হীনতা, মূল্যায়ন না করা থেকে অভিমান ও আক্ষেপ দিন দিন বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে সভা সমাবেশে শরিকদের চেয়ার ও বক্তব্য দিতে না দেয়া, ১৯ দলের সংবাদ সম্মেলন বলে প্রচার করলেও আমন্ত্রণ না জানানো, কর্মসূচি চূড়ান্ত করেও না জানানো দূরত্ব বাড়িয়ে তুলছে।

যার ফলশ্রুতিতে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ ভাসানী) মতো জোট ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে একাধিক দল। ১৯ দলীয় (বর্তমানে ১৮) ছয় শরিক দলের প্রধান নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলামেইলের সঙ্গে আলাপকারে এসব কথা জানান।

শরিকরা বলেন, লিখে কী হবে, কিছুই হবে না। বিএনপির নেতৃত্বে রাজনৈতিক শরিক হয়ে জোটবদ্ধ হলেও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ও জোটগত সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে শরিকরা একেবারে অদৃশ্যই বলা চলে। বিএনপি বড় দল তাই যেকোনো সিদ্ধান্ত একা নিয়ে জোটের ওপর চাপিয়ে দেয়। কিন্তু বিএনপি তাদের একার নেয়া সিদ্ধান্ত অনেক শরিককে জানানোর প্রয়োজন পর্যন্ত মনে করে না। অবহেলার একটা সীমা আছে। তাই অনেকেই জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কথা চিন্তা করছে। অবশ্য রাজনৈতি দল হিসেবে যে কোনো সিদ্ধান্ত তারা নিতে পারেই।

জোটের শরিক দলের এক চেয়ারম্যান বাংলামেইলকে বলেন, ‘আমাদের সাংগঠনিক শক্তি নেই, লোকবল নেই, পরিচিতি নেই, টাকা নেই, অনেকের নিবন্ধন নেই। সব জেনেইতো বিএনপি আমাদেরকে জোটবদ্ধ করেছে। তাহলে এখন কেন সতীনের মতো আচরণ করবে? অন্তত প্রাপ্য মূল্যায়ন ও যথাযথ যোগাযোগটা অব্যাহত না রাখলে কীসের শরিক আর কীসের নেতৃত্বে বিএনপি?’

শরিক দলের এক মহাসচিব বলেন, ‘আমার নিজ জেলায় সমাবেশ করলেন জোট নেত্রী খালেদা জিয়া। আমি সেখান থেকে সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করি। কিন্তু সেখানে আমাকে বক্তব্য দিতে দেয়া হলো না। এ বিষয়ে একাধিকবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলেও তিনি কোনো পদক্ষেপ নিলেন না। অথচ ছাত্রদল, যুবদলের নেতারা ১০ থেকে ১৫ মিনিট করে বক্তব্য রেখেছে। যদি আমার নির্বাচনী এলাকায় জোটের সমাবেশে আমি নিজে বক্তব্য দিতে না পারি তাহলে আগামীতে আমার অনুসারী ও ভোটারদের কাছে আমি কী জবাব দেবো? তাদের কাছে ভোট চাইতে যাবো কী করে?’

আরেক শরিক দলের মহাসচিব বলেন, ‘বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া রাজবাড়ীতে সমাবেশ করবেন, তার আগেরদিন রাতে ফোন করে বলা হলো আপনি রাজবাড়ীতে যান। এটা কোন তরিকার আমন্ত্রণ? প্রকাশ্যে বিএনপি নেতারা আমাদের টিটকিরি করেন। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দেশের বিভিন্নস্থানে জোটের শরিক দলের প্রার্থী ছিল। বিএনপি নির্বাচন নিয়ে অসংখ্য সংবাদ সম্মেলন করলেও জোটের শরিকদের নিয়ে একটি সংবাদ সম্মেলনও করেনি। অথচ অনেক স্থানে শরিকদের শক্ত প্রার্থীকে বসিয়ে বিএনপি প্রার্থীকে সমর্থন দেয়া হয়েছে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের এক চেয়ারম্যান বলেন, ‘ওয়েস্টিন হোটেলে ১৮ দলের পক্ষে সংবাদ সম্মেলন করেন খালেদা জিয়া। এতে জোটের শরিকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। অথচ ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ নেজামীকে সামনে আসন দেয়া হয়নি। তাই রাগ করে তিনি সেখান থেকে চলে এলেন।’

তিনি বলেন, ‘নেজামী গ্রেপ্তার হলেন সকাল ১০টায়, একঘণ্টা পর ছাড়া পেলেন। অথচ খালেদা জিয়া রাত ১০টায় নেজামীর মুক্তির দাবি জানালেন। নির্বাচনের আগের দিন পঞ্চগড়ে জাগপার এক নেতা মারা গেলো। অথচ খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলনে তার নামটা বললেন না। বললে কী ক্ষতি হতো? এমন অসংখ্য ঘটনা রয়েছে, সব বলা সম্ভব না।’

তিনি আরো বলেন, ‘সম্প্রতি গ্রেপ্তার হওয়ার আগে একটি পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সেখানে তিনি ১৯ দলীয় জোটকে রাজনৈতিক নয় আন্দোলনের জোট বলে আখ্যা দেন। বিষয়টিকে ভালোভাবে নিতে পারেনি শরিকরা। শুনেছি কয়েকটি দল জোট ছাড়ারও চিন্তা ভাবনা করছে।’
 
তবে জোট ছাড়ার সম্ভবনা রয়েছে কি না জানতে চাইলে ইসলামী ঐক্যজোটের আব্দুল লতিফ নেজামী, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) শফিউল আলম প্রধান, বাংলাদেশ আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ ভাসানী) জেবেল রহমান গাণী ও ও লেবার পার্টির ডা. মুস্তাফিজুর রহমান ইরান বাংলামেইলকে বলেন, জোট ছাড়ার কোনো সম্ভবনা নেই। আমরা বিএনপি চেয়ারপারসন ও জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে আন্দোলনে আছি, থাকবো।

উল্লেখ্য, ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি এবং ইসলামী ঐক্যজোট মিলে চারদলীয় ঐক্যজোট গঠন করে। কিন্তু কিছুদিন পরই এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি জোট থেকে বের হয়ে যায়। কিন্তু নাজিউর রহমান মঞ্জুর সমর্থক অংশ বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি জোটে থেকে যায়। পরে সরকারবিরোধী আন্দোলনকে আরো বেগবান করতে ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল বিএনপি আরো রাজনৈতিক দল নিয়ে ১৮ দলীয় জোট গঠন করে।

এদিকে গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর কাজী জাফরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি ১৮ দলীয় জোটে যোগ দেয়। এতে ১৮ দলীয় জোট পরিণত হয় ১৯ দলীয় জোটে। তবে গত সোমবার ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ ভাসানী) জোট ছাড়লে আবারো ১৯ দলীয় জোট ১৮ দলে পরিণত হয়।

No comments:

Post a Comment